গল্পঃ সোনাই মাঝি #ওমর ফারুক শ্রাবণ Breastfeeding a Toddler on Demand makes for a happy healthy 16 month old toddler + Wild Edibles | A Word From Verywell for Breastfeeding Mom

গল্পঃ সোনাই মাঝি

লেখনীর শেষ প্রান্তে,,,,,,,,
,,,,,,,,,ওমর ফারুক শ্রাবণ

সন্ধ্যায় মেয়েটি ছুটে এসে নৌকায় উঠল। হাঁপিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

"মাঝি দ্রুত নৌকা ছাড়ো। খারাপ লোকেরা আমার পিছু নিয়েছে।"
আমি আর কিছু জিজ্ঞেস না করেই নৌকা ঠেলে বৈঠা হাতে নিলাম। শ্যামবর্ণ গায়ের রং মেয়েটির। ভাগ্যিস সন্ধা পেরিয়ে রাত হয়নি। চতুর্দিকে শুধু খারাপ মানুষের গল্প শুনি। ছোটো থাকতে চাচা শুধু ভালো মানুষের গল্প বলতেন। অমুক গ্রামের অমুক লোকটা কত ভালো মানুষ ছিলেন, সেসব গল্প। ভালো মানুষগুলো মনে হয় গল্পেই বসত করে। আবার মনে পড়ে চাচার কথা। আমার চাচা একজন ভালো মানুষ ছিলেন। 

কিন্তু তার কোনো গল্প নেই।
মেয়েটির চেহারায় এখনো ভয়ের ছাপ। কোথায় যাবে সেটাও জানি না। বাধ্য হয়েই জানতে চাইলাম, "কোথায় যাবেন? নৌকা কোনদিকে নিয়ে যাব?"
মেয়েটি এতক্ষণে আমার দিকে তাকালো। সূর্যের আলো নিভে গেছে। বলল,
"আমাকে বাঁশখালী মির্জারচরে নিয়া যান।"
শুনে তো আমার মাথায় হাত। আমি বৈঠা থামিয়ে বললাম,
"আমার নৌকা তো ইঞ্জিনের না। ইঞ্জিনের নৌকায় ঘন্টা তিনেকের পথ। বৈঠা দিয়ে তো এক দিন এক রাত লাগবে।"
মেয়েটি বলল,

"আমার অসুবিধে নেই। আপনি নিয়ে চলুন। এই নিন আমার কানের দুল। তবুও আমাকে নিয়ে চলুন।"
মেয়েটি হাত দিয়ে কানের দুল খুলতে লাগলো। আমি বাঁধা দিয়ে বললাম,
"এখন খুলতে হবে না। কিন্তু রাতের বেলা কূলের দেখা পাবো কীভাবে?"
মেয়েটি আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,
"জ্যোৎস্না আছে মাঝি। অসুবিধা হবে না। এই বিপদে আপনিও মুখ ঘুরিয়ে নিলে ভালো মানুষ আর পাব কোথায়?"

আমার খুব ভালো মানুষ হওয়ার ইচ্ছে। গল্পের মতো ভালো মানুষ।
রাতের বেলা নদী কত শান্ত। যেন ঘুমিয়ে আছে। তার উপর দিয়ে কতশত নৌকা চলে যাচ্ছে তাতে তার ভ্রুক্ষেপ নেই। বৈঠা মেরে সামনে তাকিয়ে দেখি এক খণ্ড চাঁদ। মায়াভরা জ্যোৎস্না মাখা চাঁদ। যেন আকাশের চাঁদ এসে বসে আছে আমার নৌকার ভিতর। কিন্তু চাঁদটা হাসে না। আঁচলে চোখ মুছে। আমি তাকে স্বাভাবিক করতে বললাম,
"করিমপুরে আপনার কে থাকে? আর মির্জারচর কার কাছে যাচ্ছেন?"
মেয়েটি মাথা তুলে তাকালো। বলল,

"নিয়তি টেনে এনেছিল আবার নিয়তিই নিয়ে যাচ্ছে। যেখানে নিয়ে যাচ্ছে সেখানেও থাকতে পারব কি-না নিয়তি ভালো জানেন।"
আমি মেয়েটির কথা কিছুই বুঝতে পারছি না। জানতে চাইলাম,
"থাকতে পারবেন না কেন?"
জবাবে বলল,

"বাবা মা আমাকে ত্যাজ্য করেছে। জানি না গেলে আমাকে আশ্রয় দিবে কি-না।"
আমার হাতের বৈঠা কিছুক্ষণের জন্য চলা বন্ধ হয়ে গেল। আমি বললাম,
"অনেক দূরের পথ। কথা বললে সময় কাটবে। আপনি বলুন কেন ত্যাজ্য করেছে আপনাকে?"
মেয়েটির দুঃখ দেখে ইচ্ছে করছে, যদি তার মাথা আমার কোলে থাকত। আমি বৈঠা মেরে চলতাম আর তার গল্প শুনতাম। যতক্ষণ ভোর না হয় ততক্ষণ চলতেই থাকত পথচলা, গল্প বলা।
মেয়েটি বলতে লাগলো...

"আমি নুড়ি। আমরা এক ভাই আর দুই বোন। আমি সবার ছোটো। আমি ছোটো বলেই সবাই আমাকে আদর করত। যাকে আদর করে বেশি, যাকে ভালোবাসে বেশি, সে যদি আঘাত দেয় তা অনেক বড়ো আঁকার ধারণ করে। আমি সবার মনে কষ্ট দিয়েছি, আঘাত করেছি।"
নুড়ি কাঁদতে শুরু করলো। আমার থেকে তিন চার হাত দূরে বসা। ইচ্ছে করছে তার চোখের পানি মুছে দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেই। কিন্তু এতে আমার ভালো মানুষ হয়ে উঠা হবে না। ভালো মানুষেরা কখনো মেয়ে দেখলেই বুকে জড়াতে চাইবে না। আমি বললাম,
"থাক গল্প বলতে হবে না। আমি চাই না আপনি কান্না করুন।"
মেয়েটি কান্না থামিয়ে আবার বলতে শুরু করলো...

"এলাকায় আমার নামই ছিল দুষ্টু মেয়ে। গাছে উঠা, সাইকেল চালানো, সারা গ্রাম টৈ টৈ করে ঘুরে বেড়ানো ছিল আমার বৈশিষ্ট। কিন্তু একটি ছেলে আমার সব কেড়ে নিলো। আমার দুরন্তপনা, আমার দুষ্টুমি, সব। আমার মনটাকেই নিজের করে নিলো। আমাদের এলাকার এক ভাবীর ছোটো ভাই ছিল সে। প্রায়ই যেত আমাদের গ্রামে। তার নাম স্বপন। সে আমাকে প্রথম ভালোবাসি বলেছিল। আমি না করে দিতে পারিনি। 

কারণ একই দোষে আমিও ছিলাম দোষী। অল্পদিনেই বাবা মা জেনে গেলেন। মানুষ প্রেমে পড়লে হিংস্র হয়। কিছুটা বেয়াদব হয়, প্রতিবাদী হয়। আমি তর্ক করতাম বাবা মায়ের সাথে, স্বপনের জন্য। বাবা মা আমাকে কাছে রাখতে চেয়েছিল। এত দূরের পথ শুনে স্বপনকে ভুলে যেতে বললো। কিন্তু আমি ভুলব কীভাবে? আমিও যে ততদিনে ভালোবাসার মানুষটিকে পাবার জন্য হিংস্র হয়ে উঠেছি।
মাঝি নৌকা কোনদিকে চলে যাচ্ছে দেখেন।"

নুড়ির কথা শুনতে শুনতে বৈঠা মারতে ভুলে গেছি। নৌকা উলটো দিকে চলে যাচ্ছে। নৌকা ঘুরিয়ে আবারো বৈঠা মারতে লাগলাম। দৃষ্টি আর মনোযোগ নুড়ির কথার দিকে।
"বাবা মা আমাকে শাসন করলেন, মারধোর করলেন। এতে করে আমি আরো হিংস্র হয়ে উঠি। স্বপন তখন তাদের বাড়ি চলে যাবে। তার বড়ো বোন বলেছিল, 'এটা আমার শ্বশুর বাড়ির এলাকা। তোর জন্য আমার সংসারেও সমস্যা হবে। তোকে আর এখানে থাকতে হবে না, বাড়ি চলে যা।'

যাদের বাড়ি তারা যদি থাকতে না দেয় তাহলে স্বপনকে অবশ্যই চলে যেতে হবে। কিন্তু স্বপন চলে যাচ্ছে আমি মানতে পারছি না। মনে হচ্ছে চিরদিনের জন্য আমাকে ছেড়ে যাচ্ছে। সে চলে গেলে বাবা মা হয়তো আমাকে বিয়ে দিয়ে দিবে। আমি চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলব স্বপনকে। তাই নির্লজ্জের মতো বাবা মা'কে বলে ফেলেছি, স্বপনের সাথে আমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য। বাবা শুনে লাঠি হাতে নিলেন। কেউ বাবাকে আটকাতে পারছে না। আমি বললাম, 'যদি স্বপনের কাছে বিয়ে না দেও তাহলে স্বপনের সাথে চলে যাব।'

জানি না তখন মাথায় কোন শয়তান ভর করেছিল আমার। বাবা শুনে আমাকে ঘরে বন্দী করলেন। আমি খাটের নিচ থেকে বটি বের করে ভয় দেখালাম। আমাকে যেতে না দিলে আমি মরে যাব। বাবা তখন চূড়ান্ত রাগ করলেন। আমাকে তেজ্য করলেন। আমিও বাবা মায়ের ভালোবাসার কথা ভুলে ক্ষণিকের ভালোবাসার জন্য স্বপনের হাত ধরে চলে এলাম। বাবা মা'কে যে কষ্ট আমি দিয়েছি, দোজখেও আমার স্থান হবে না।"

নুড়ির কান্না কিছুতেই থামছে না। মেয়েটি তার ভুলের জন্য অনুতপ্ত। এবার আমি উঠে গেলাম নুড়ির কাছে। কাছে বসে আমি নুড়ির মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার সময় সে আমার কাঁধে হাত দিলো। সে হাতে মাথা রেখে চোখের জল বিসর্জন দিচ্ছে। আমি চোখের পানি মুছে দিলাম। মানুষ একমাত্র কান্নার সময় আপন পর চিনে না। তখন যাকে কাছে পায় সেই তার কাছে এই দুনিয়ার সবচেয়ে আপন মানুষ।
-ও মাঝি, তোমার নাম কী?

রাত তখন অনেক। জ্যোৎস্নার আলোয় পানির নিচে চাঁদ দেখা যায়। উপরের চাঁদটা আমাদের সঙ্গী হয়েছে। ছোটো বেলা আমরা দৌড়াতাম আর একজন অন্যজনকে বলতাম,
"এই যে চাঁদ আমার সাথে চলে এসেছে। বিশ্বাস না করলে আমার কাছে এসে দেখে যা।"
মানুষ খুব দ্রুত বড়ো হতে চায়। কিন্তু যখনি বুঝে সে সত্যি বড়ো হয়ে গেছে তখন আবার ছোটো হতে চায়। চাঁদ নিয়ে খেলা করার মতো ছোটো।
-ও মাঝি, নাম বলবা না?

নুড়ির কথায় অবাকই হলাম। বললাম,
"আমার নাম অনেক বছর ধরে জিজ্ঞেস করে না কেউ। যাদের ইঞ্জিনের নৌকা আছে তাদের একটা নাম আছে। অমুকের নৌকা, তমুকের নৌকা। আমাকে তো সবাই মাঝি বলেই ডাকে। নিজের নাম ছিল সোনাই। অনেকদিন কেউ এই নামে ডাকে না। তুমি ডাকবা নুড়ি?"
-তোমার বাবা মা, ভাই বোন তারাও তোমাকে নাম ধরে ডাকে না?

কিছুক্ষণের জন্য বৈঠা মারা বন্ধ করলাম। কোনোদিন একটানা নৌকা এত চালাইনি। হাটু ভাঁজ করে বসে নুড়ির দিকে তাকিয়ে বললাম,
"চার কূলের তিন কূলেই আমার কেউ নেই নুড়ি। এক কূলে আমার এই নৌকা আর উজান চরে একটা ভিটা। আমার কথা ছাড়ো, তোমার কথা বলো।
তারপর স্বপনের সাথে করিমপুরে চলে এসেছিলে?"

-হ্যাঁ, আজ সকালেই তো এসেছিলাম। স্বপনের বাবা মা আরো বেশি ভয়ংকর, সে কথা নৌকায় থাকতে স্বপন আমাকে জানিয়েছে। যখন বললাম তাহলে উপায়? তখন বলল, "বিয়ে করে দু'দিন পর বাড়িতে গিয়ে উঠলেই বাবা মা মেনে নিবে। সে পর্যন্ত বন্ধুর কাছে থাকব।' আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বাড়ির কথা মনে করলাম। বাবা মা'কে ছেড়ে চিরদিনের জন্য অজানায় দিলাম পাড়ি।

আমাকে নিয়ে দুপুরে তার বন্ধুর কাছে গেল। তার বন্ধু বাড়িতে একা থাকে। বন্ধুর বাবা মা কোথায় আমি জানি না। দুপুরে হোটেলের খাবার খেলাম। আমার আর স্বপনের জন্য তার বন্ধু একটি রুম গুছিয়ে দিলো। আমাকে স্বপন সেই ঘরে নিয়ে যাচ্ছে। আমার কেমন একটু ভয় হলো। সারা শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেল। আমি স্বপনকে বললাম, 'চলো আমরা আগে বিয়ে করি। একটু পরেই তো সন্ধা হয়ে যাবে।' 

সে আমাকে অবাক করে দিয়ে বললো, 'বিয়ে দুই তিন দিন পর দেখা যাবে। এখন চলো ঘরে যাই, মানুষ দেখলে নানান কথা বলবে।'
আমি বিশ্বাস করতে পারছি না স্বপন এমন কথা বলতে পারে! যার জন্য সব ছেড়ে চলে এলাম সে দুই তিন দিন পর বিয়ে করবে কেন? আর বিয়ে ছাড়া আমরা এক ঘরে থাকব কেন? আর দুই তিন পর যদি সে আর বিয়ে না করে? আমার মাথায় হাত। আমি বললাম, 'না স্বপন হাত ছাড়ো। আগে বিয়ে করো।'

স্বপন অগ্নিচোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, 'লীলা শুরু করছিস কেন? বলছি না দুই তিনদিন পর বিয়ে করব? আয় ঘরে আয় বলছি।'
এই স্বপন আমার ভালোবাসার স্বপন না। এটি অন্য কেউ, আলাদা জগতের কেউ। সে আমাকে টেনে হিঁচড়ে ঘরে নেওয়ার চেষ্টা করছে। আমি স্বপনের হাতে কামড় দিয়ে দৌড় দিলাম। সেও পিছু নিল। কিছু পথ দৌড়ে আসার পর সে আমাকে প্রায় ধরে ফেললো। রাস্তায় চলাচল রতো মানুষের কাছে সাহায্য চাইলাম। চিৎকার করে বাঁচাতে বললাম আমাকে। এই দেশে আর যাই হোক, মেয়েরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে চিৎকার দিলে মানুষের অভাব হয় না।
মানুষজন স্বপনকে আটকিয়ে জিজ্ঞেস করল আমাকে দৌড়াচ্ছে কেন? কেউ চড় থাপ্পড় দিচ্ছে। আমি বললাম, ভাইয়েরা আমি নৌকায় উঠা পর্যন্ত এই লোকটাকে ছাড়বেন না। আমি দৌড়ে এসে তোমার নৌকায় উঠলাম। 

তার পর থেকে তো তোমার সাথেই ভেসে চলছি।
নুড়ি এতটুকু বলার সময় কাঁদেনি। কিন্তু বর্ণনা করার সময় চোখ বড়ো করে ঘাড়ের কপালের রগ শক্ত করে বর্ণনা করছিলো। এখন তাকে বেশ শান্ত ও স্বাভাবিক লাগছে। মোটামোটি যুদ্ধে জয়লাভ করার মতো আনন্দিত। কিন্তু একটু আগেই কান্না থামানো যাচ্ছিলো না। পৃথিবী কত বিচিত্র। তার চেয়েও বিচিত্র পৃথিবীর মানুষ। এই হাসি কান্নার খেলায় আমরা সবাই বেশ পারদর্শী। নুড়িকে জিজ্ঞেস করলাম,
"বাবা মায়ের কাছে যাবে?"

-বাবাকে আমি ভালো করেই চিনি। তার মনে যে আঘাত করেছি আমার চেহারাও দেখতে চাইবে না। মূলত আমার এলাকা আমার পরিচিত। আমার এলাকায় আমি নিরাপদ। তাই সেখান থেকে ছুটে এসে বলেছি মির্জারচরে যেতে। আমার তো আর কোনো ঠিকানা জানা নেই সোনাই। যদি পারতাম তোমার এই নৌকাতেই ভেসে থাকতাম। কূলের মানুষের চেয়ে এই মাঝ নদীর নৌকা ঢের ভালো।
আমি বললাম,

"এই মাঝ নদীতেও তো একটা মানুষ তোমার পাশে বসা। তাকে ভয় হয় না?"
-প্রথমে একটু ভয় লেগেছিল। যখন আমার চোখের পানি মুছে দিলে তখন আর ভয় নেই। যে চোখের পানি মুছে দেয় সে সহজে চোখের পানি ঝরায় না। তোমাতে আমার বিশ্বাস জন্মেছে। তুমি বিয়ে করেছো মাঝি?

-বিয়ে না করলে তুমি করবে না-কি? হা হা। আমার সাথে কার বিয়ে হবে? উজান চরে শুধু একটি ঘরই আছে। সেই ঘরে তো আমি ছাড়া আর কেউ থাকে না। আমার বাবা-মা কে আমি জানি না। এই নদীর জলেই আমার ভেসে চলা। চাচা অবশ্য পরে স্বীকার করেছেন। আগে এলাকার কয়েকজন বলেছে। আমাকে না-কি নদী থেকেই পেয়েছে চাচা। নদীতে মাটির হাড়ির ভিতর একটি ছোট্ট শিশু কান্না করছে। সে জানে না সে কোথায় এসেছে কেন এসেছে? পৃথিবীর কোনো নিয়ম কানুনই সে জানে না। ঐ চাচা আমাকে নদী থেকে তুলে মানুষ করলেন। চাচা ছিলেন এই নৌকার মাঝি। চাচারও কেউ ছিল না। মাঝির কাছে কেউ মেয়ে বিয়ে দিতে চায় না। আবার ইঞ্জিনের নৌকা হলে মেয়ের অভাব হবে না। এই নৌকায় আয় কম, শাক শুটকি খেয়ে জীবন পাড়ি দিতে হয়।

চাচা আমাকে নয় ক্লাস পড়াইছেন। চাচা মারা যাওয়ার পর আর পড়া হয়নি। কলমের বদলে এই বৈঠা হাতে নিলাম। হয়ে গেলাম মাঝি। এবার বলো কে বিয়ে করবে আমাকে? কে খেতে পারবে বারো মাস শাক শুটকি?
নুড়ি চুপ করে নদীর দিকে তাকিয়ে আছে। যেন নীরবতা কোনো ভাষা।
নুড়ি হঠাৎ বলে উঠলো,
"সোনাই নৈাকা ঘুরাও।"
আমি নুড়ির কথা কিছুই বুঝতে পারলাম না। সে কি আবার স্বপনের কাছে যেতে চায়? আমি জানতে চাইলাম,
"এত দূর এসে আবার ফিরে যাবে?"
নুড়ি বলল,
"সোনাই। উজান চরে না তোমার একটা ভিটা আছে? একটা ঘর আছে! সে ঘরে তোমার সাথেও তো একটা মানুষ লাগে। তুমি শাক শুটকি খেয়ে জীবন পার করবে সে শাক শুটকি রান্না করে দেওয়ার জন্যও তো একটা মানুষ লাগে। আমারে তোমার ঘরে নিবা সোনাই? আমি শাক শুটকি খেতে পারি। করবা বিয়া আমারে?"
আমি নৌকা ঘুরালাম। আমার ঘরে দু'দিন হলো যাই না। এখন যেতে যেতে সকাল হবে। কিছু বাজার করে নিয়ে যেতে হবে। এই জনমে কোনো মেয়ের হাতের রান্না আমার খাওয়া হয়নি। আমার একটা মানুষ লাগবে। শুধু রান্না করে দেওয়ার জন্য নয়। আমার কোলে কেউ শুয়ে গল্প বলবে, আমি মাথায় বিলি কেটে গল্প শুনব। এতে যদি আমার ভালো মানুষ হয়ে উঠা না হয়, তাতে দুঃখ নেই। আমি গল্পের মতো ভালো মানুষ হতে চেয়েছিলাম। জ্যোৎস্নার আলোয় নুড়ির চোখে নতুন গল্প দেখতে পাচ্ছি। গল্পটা আমাকে সাজাতেই হবে। মাঝির জীবনের গল্পটা নতুন করে সাজানো দরকার। নৌকা চলছে উজানচরের সোনাই মাঝির ভিটার দিকে।
সমাপ্ত....
(রি-পোস্ট)

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url