Prokritit Protishodh | প্রকৃতির প্রতিশোধ - আফরিনা সাথী

#প্রকৃতির_প্রতিশোধ
#আফরিনা_সাথী

 

১.অনেক অনুরোধের পর নিজের পছন্দের মোবাইল ফোন কিনে রাত্রি যেদিন ভার্সিটিতে গেল,সেদিন ওর বান্ধবী ফোনটা দেখে ভীষণ হাসাহাসি করল।দরকার হলে ও মোবাইল ছাড়া থাকবে তবুও নাকি এমন সস্তা মোবাইল কখনোই ব্যবহার করবেনা।এসব কথা হাসি মুখেই রাত্রিকে শুনিয়ে গেল।রাত্রিও সবটাই হজম করল।কেননা বান্ধবীর বাবার মত ওর বাবার এতো টাকা নেই।আর এই সস্তা মোবাইল পেয়েই ও বেশ খুশি।

এর কিছুদিন পর বান্ধবীটির সাথে রাত্রির আবার দেখা।দুজনে একই ডিপার্টমেন্টের না হওয়ায় নিয়মিত দেখা হয় না।বান্ধবীর ভীষন মন খারাপ।তার সাধের দামি মোবাইলটা নাকি কয়েকদিন আগে ছিনতাই হয়ে গেছে।রাত্রি তাকিয়ে দেখল বান্ধবীর হাতে শোভা পাচ্ছে ওরই মতো একটা,সস্তা মোবাইল।

২.দিয়ার হাসবেন্ডের ব্যবসায় অনেক টাকা লস হয়েছে।তাই দিয়া কিছুদিনের জন্যে বাবার বাড়িতে থাকতে গেছে।কিন্তু এ নিয়ে ভাইয়েদের মধ্যে বিশাল আলোচনা সভা চলছে।এক ভাই বলছে বোনকে রাখবে, তো আরেক ভাই বলছে রাখবেনা।আলোচনার এক পর্যায়ে মেজ ভাই বলল,করলি তো নিজের পছন্দে বিয়ে।আমি আমার কলিগের সাথে বিয়ে ঠিক করেছিলাম তাতো পছন্দ হলো না।জীবন তো আমাদের।এমন চাকরিজীবীর বউ হলে তোর ভাবির মতো আয়েশি জীবন কাটাতে পারতিস।

এরপর দিয়া বাবার বাড়ি ছেড়ে চলে যায়।কিছুদিন কষ্ট করার পর ওর হাসবেন্ডের ব্যাবসা আগের মত হয়ে যায়।তবে বছরখানেক পর আচমকাই ওর মেজো ভাইয়ের চাকরিটা চলে যায়।ভাবির আয়েশি জীবনটাও থেমে যায়।

৩.নীলা আর আসিফের প্রেম অনেকদিনের।আসিফ এখনো বেকার।অনেক বলেও আসিফ কাজের কোন চেষ্টা করছেনা।এদিকে নীলার জন্যে পাত্র দেখা হচ্ছে।অনেকবার বিয়ে ভেংগেছে ও।তবে এবার আর পারবে বলে মনে হচ্ছেনা।তাই ও একদিন আসিফের বাড়ি গিয়ে উঠলো। কিন্তু আসিফ ওর মায়ের দোহায় দিয়ে নীলাকে ফিরিয়ে দিল।নীলাকে নাকি ওর মা মেনে নেবেনা গায়ের রং কালো বলে।

কয়েক বছর পর একদিন বাবার বাড়ি আসার পথে নীলা,আর আসিফের দেখা।নীলার কোলে ওর ১ বছরের ছেলে। আসিফের কোলেও একটা বাচ্চা।কাছাকাছি হতে নীলা জানতে চাইলো বাচ্চাটা কার?আসিফ জানালো এটা ওর মেয়ে।নীলা দেখলো বাচ্চাটা ওর চেয়েও কালো।নীলা অশ্রুসজল নয়নে মনে মনে বলল,মারে বড় হয়ে আমার মতো কোন অমানুষকে ভালোবেসে ভুল করিস না।

৪.তানিয়ার হুট করেই বিয়ে হয়ে গেছে।তাই বন্ধুমহলের সবাইকে জানাতে পারেনি।তাই কয়েকটা কাপল ছবি পোস্ট করে বিয়ের খবরটা সবাইকে জানায়।
কিছুক্ষণ পরেই ওর বান্ধবী রুমা ইনবক্স করে
,যেই বয়সের লোককে বিয়ে করেছিস তাতে তো অর্ধেক জীবনই একা কাটাতে হবে।অবশ্য সবার ভাগ্য তো আর আমার মতো না।

বান্ধবীর কথা শুনে তানিয়ার দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়াতে থাকে।
কয়ের বছর পর হঠাৎই রুমার সাথে তানিয়ার দেখা।রুমাকে দেখে কেমন বিমর্ষ লাগছিল। কথা প্রসঙ্গে জানতে পারলো কিছুদিন আগে রুমার হাসবেন্ড একটা রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে।সেদিন ও তানিয়ার দু চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।

৫.হঠাৎ করেই মিলির চাকরিটা চলে গেল।মাসের মাঝামাঝি হলেও বাড়িওয়ালাকে অনেক অনুনয় বিনয় করল সে বাসাটা ছাড়ার জন্যে।কারন একমাস ঢাকা শহরে থাকার মতো টাকা ওর নেই।কিন্তু বাড়িওয়ালা কিছুতেই মিলির কথা শুনল না।কারন নিয়ম অনুযায়ী মাসের প্রথমে বাসা ছাড়তে হবে।আর একমাস বাসা খালি থাকলে তার নাকি অনেক লস হবে।অথচ মাসে তিনি ২ লাখের মতো বাড়ি ভাড়া পান।মিলি কষ্ট পেলেও আর কিছুই বলেনি সেদিন।
একটা মাস কষ্ট হলেও থেকেই গেল মিলি।এদিকে হঠাৎ করেই বাড়িওয়ালার বড় ছেলেটা স্ট্রোক করে ঢাকার নামকরা প্রায়ভেট হাসপাতালে ভর্তি হল।৭ দিন পর লাখ দশেক টাকা দিয়ে ছেলেকে বাড়ি ফেরালো বাড়িওয়ালা।


=========================
গল্পঃ যোদ্ধা
লেখিকাঃ নাবিহা নুপুর

আজ সকালে ওয়াসরুমে পা পিছলে পড়ে গিয়ে আম্মুর পায়ে ফ্র্যাকচার হয়েছে। ব্যাথায় চোখ-মুখ নীলবর্ণ ধারণ করেছে আম্মুর। বাড়িতে একটা হুলুস্থুল পড়ে গেছে এই নিয়ে। আব্বু বাসায় নেই, চাচ্চুও বাজারে গেছেন। এখন আম্মুকে ডাক্তারের কাছে কে নিয়ে যাবে? এই নিয়ে বাড়িতে প্রশ্নের গুঞ্জন উঠলো। সব গুঞ্জন থামিয়ে দাদি আমাকে বললঃ সিফাত, বউ মাকে নিয়ে তুই যা হাসপাতালে।

আমি তখন আম্মুকে নিয়ে হাসপাতালে রওনা হলাম। আম্মু ব্যাথার দাপটে থেকে থেকে ককিয়ে উঠছেন, আমি সান্ত্বনা দিচ্ছি। কিন্তু সান্ত্বনাই আদতে কোনো কাজ হচ্ছে না, আম্মু ক্রমশ আরও অশান্ত হয়ে উঠছেন। কিছুক্ষণ পর হাসপাতালে পৌছালাম। ডাক্তার আম্মুর পায়ের ব্যাথার কথা শুনে প্যাডের উপর কলম দিয়ে খচখচ করে কিছু একটা লিখে কাগজটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললঃ এখান থেকে আপনার আম্মার পায়ের একটা এক্স-রে করিয়ে আনুন, তারপর আমি রিপোর্ট দেখে পরবর্তী ব্যবস্থা নেবো।

আমি আম্মুকে একটা হুইলচেয়ারে বসিয়ে লিফটে করে নিচতলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারটায় গিয়ে উপস্থিত হলাম। আম্মু ব্যাথার চোটে কাঁদতে শুরু করেছেন, আমি আবার সান্ত্বনা দিয়ে বললামঃ ঠিক হয়ে যাবে আম্মু, কেঁদো না।

এক্স-রের রুমটায় ভিড় একদম নেই বললেই চলে। শুধু একটা বছর পাঁচেকের বাচ্চা ছেলের হাতের এক্স-রে চলছে। আম্মুকে নিয়ে আমি ডায়াগনস্টিক সেন্টারটার তত্ত্বাবধানে যে ছেলেটা আছে তার ডেস্কের পাশেই দাঁড়িয়ে আছি। আম্মু এবার ব্যাথার চোটে কাঁদতে কাঁদতে বললঃ আমারই কপাল রে, হায় আল্লাহ, কয়েকমাস আগেই মাজার অপারেশন হলো এখন আবার এই পা ভাঙলো। আমার শান্তি নাই রে, শান্তি নাই। আল্লাহ শুধু আমাকেই চোখে দেখতে পাই, সব ঝড় আমারই।

এধরনের কথা বলে আম্মু বিলাপ শুরু করলো। আম্মু হাই ব্লাড প্রেশারের রোগী হওয়ায় একটুতেই উত্তেজিত হয়ে পড়েন আবার অল্পতেই নার্ভাস ব্রেকডাউনের শিকার হন। আমি আবারও আম্মুকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে ব্যর্থ হলাম। আম্মু একনাগাড়ে বিলাপ করেই যাচ্ছেন, এমন সময় হঠাৎ আম্মু চুপ করে গেলেন কারো কথায়ঃ আমার দিকে একটু তাকান তো চাচি।

কথাটা বলেছে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের তত্ত্বাবধানে থাকা ছেলেটা। সে এতোক্ষণ ডেস্কে বসে আম্মুর বিলাপ শুনছিল, এখন সে আম্মুর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি আর আম্মু দুজনেই বেশ অবাক হয়ে এবার ছেলেটার দিকে ভালো করে তাকালাম। ছেলেটা সুপুরুষ, বয়স ২৫-২৮ এর মধ্যে হবে, সুশ্রী চেহারা কিন্তু ছেলেটার বাম পায়ের অর্ধেকটা নেই। ছেলেটা একটু বাম দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে কারণ ছেলেটার বাম হাতে একটা স্ক্র্যাচ। ছেলেটা এতোক্ষণ ডেস্কের আড়ালে বসে ছিল বলে আমরা ওটা দেখতে পায়নি। ছেলেটা আম্মুকে চুপ থাকতে দেখে আবার বললঃ চাচি, আমাকে একটু ভালো করে দেখুন।
আম্মু একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললঃ কি হয়েছে বাবা?

- কিছুই হয়নি চাচি, শুধু আমাকে একটু দেখতে বলছি।
- কিন্তু কেন?
- আমার বাম পায়ের অবস্থাটা দেখছেন, চাচি। হাঁটুর নিচ থেকে আমার বাম পা টা কাটা।
- এসব কি করে হলো বাবা?

- বছর তিনেক আগের কথা তখন আমি নতুন বিয়ে করেছি। আমার স্ত্রী শিলার সাথে আমার বিয়েটা ঘরোয়া ভাবেই হয়েছিল। শিলার সাথে আমার সম্পর্কটাও খুব মিষ্টি ছিল, অগোছালো আমিকে একদম গুছিয়ে দিয়েছিল মেয়েটা। বছর ঘুরতেই আমার ঘর আলো করে এক ছোট্ট রাজকন্যা এলো। বৃষ্টির পর মাটিতে যে গন্ধটা তৈরি হয়, সেটা শিলার খুব পছন্দ। তাই শিলা, আমাদের মেয়ের নাম রাখলো মৃত্তিকা। ছোট্ট মৃত্তিকাকে নিয়ে আমাদের জীবন আনন্দেই কাটছিলো। কিন্তু বিপত্তিটা ঘটলো বছর দেড়েক আগে। সেদিন আমার বন্ধুর বাড়িতে আমাদের দাওয়াত ছিল। আমার বাইকে করে আমরা তিনজন রওনা হলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর মৃত্তিকা হঠাৎ বলে উঠলোঃ পা পা…

মৃত্তিকার কথায় আমি ও শিলা দুজনই অবাক হলাম। কারণ, মৃত্তিকা তখন কিছু অস্ফটু শব্দ বলতো ঠিকই কিন্তু কোনো অর্থবহ শব্দ তখনও বলতে পারতো না। কিন্তু সেদিন বাইক চলাকালীন সময়ে হঠাৎই মৃত্তিকা পাপা বলে উঠেছিল। ওর কথায় আমি আবেগাপ্লুত হয়ে পিছনে তাকিয়ে শিলাকে বললামঃ দেখলে তো, আমার কথা মিললো কি না? বলেছিলাম না, আমার মামনিটা আমাকেই বেশি ভালোবাসে। শুনলে কেমন….

আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই আমার বাইকটা সজোরে কিছু একটাই ধাক্কা খেয়ে রোড থেকে ছিটকে গিয়ে মাটির রাস্তায় পড়লো। তারপর আর আমার কিছু মনে নেই। যখন জ্ঞান ফিরলো, তখন নিজেকে হাসপাতালের বেডে মাথায় ব্যান্ডেজ লাগানো অবস্থায় আবিষ্কার করলাম। আমি উঠতে চেষ্টা করতেই আমার পাশে বসা আমার বড় ভাইয়া বললঃ এই কি করছিস শান্ত? একদম উঠিস না, শুয়ে থাক।
আমি দূর্বল শরীরে আস্তে আস্তে ভাইয়াকে বললামঃ ভাইয়া, শিলা আর মৃত্তিকা কেমন আছে? ওরা ভালো আছে তো?
আমার কথা শুনেই ভাইয়া কান্নায় ভেঙে পড়লেন। আজ পর্যন্ত আমি কখনো ভাইয়া এভাবে কাঁদতে দেখি নি। তাই ভাইয়ার কান্না দেখে অজানা বিপদের আশংকায় আমার রুহ্ কেঁপে উঠলো। আমি চট করে শোয়া থেকে উঠে বসে দৌড় দিতে গিয়ে খেয়াল করলাম আমার…
আমার বাম পায়ের অর্ধেকটা নেই। আমি আহত চোখে ভাইয়ার দিকে তাকাতেই ভাইয়া চোখ ফিরিয়ে নিলো। আমি তখন নিজের কথা আর ভাবি নি, ভাইয়ার কাঁধে ভর করে নিজের স্ত্রী আর ছোট্ট মেয়েটাকে শেষ বারের মতো দেখতে গিয়েছিলাম। মেয়েটার আমার মাথার পেছন দিকটা থেতলে গেছিলো আর শিলার পাজর…

শান্ত কান্নায় ভেঙে পড়লো। তারপর নিজেকে কিছুটা সামলে কান্নাজড়িত কন্ঠেই বললঃ আমি এমনই অভাগা যে, নিজের স্ত্রী-সন্তানের শেষ যাত্রার বাহনের একটুখানি ভরও নিজের কাঁধে নিতে পারিনি।

শান্ত জোরে জোরে কাঁদতে শুরু করলো। আমার আর আম্মুর চোখেও অশ্রু জমেছে। আম্মু শান্তকে বললেনঃ কেঁদো না বাবা, এভাবে কাঁদতে নেই।
কিছুক্ষণ পর শান্ত নিজেকে ধাতস্ত করে বললঃ চাচি, এবার বলুন তো, আপনার ঝড় কি আমারটার থেকেও বড়? ওই একটা ঝড় এসে আমার পুরো জীবনটাই ওলট-পালট করে দিলো। এক নিমেষে আমার স্ত্রী, আমার ছোট্ট মেয়েটা আর আমার পা, সব কেড়ে নিলো।
আম্মু নিশ্চুপ রইলেন। শান্ত আবার বললঃ চাচি,আপনার পায়ের ফ্র্যাকচার চার সপ্তাহেই সেরে যাবে। আল্লাহর রহমতে, আপনি আবার সুস্থ জীবনযাপন করতে পারবেন। ঝড় যে, আপনার বড় কোনো ক্ষতি করেনি, এটার জন্য আপনার উচিত অযথা বিলাপ না করে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা।
শান্ত তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললঃ কি ভাই ঠিক বলছি তো?
আমি মুচকি হেসে ঘাড় নেড়ে সায় দিলাম। আম্মু হঠাৎ আপনমনেই বললেনঃ আলহামদুলিল্লাহ।

শান্ত এবার বিষন্নতা ঝেড়ে ফেলে হেসে বললঃ চলুন চাচি, বাচ্চাটার এক্স-রে হয়ে গেছে। এবার আপনাকে নিয়ে যাই।

শান্ত এগিয়ে গেল এক্স-রে রুমের দিকে আমি আম্মুকে নিয়ে ওকে অনুসরণ করলাম। শান্তকে পেছন থেকে দেখে তখন আমার অনেকদিন আগে পড়া “কাঠের পা” গল্পের মুক্তিযোদ্ধার কথা মনে পড়ে গেল। সেই মুক্তিযোদ্ধার মতো শান্ত নামের ছেলেটাও প্রতিনিয়ত নিজের জীবনের সাথে সংগ্রাম করে বেঁচে আছে। আমাদের আশেপাশে এমন কত শান্তই না আছে, যারা জীবনের কালবৈশাখী ঝড়কে সামাল দিয়ে হাসিমুখে কাজ করে চলেছে আর আমরা সামান্য প্রেমিক/প্রেমিকার সাথে ঝগড়া হলেও জীবন শেষ করতে চাই। শান্তর মতো জীবন যুদ্ধে জয়ী যোদ্ধাদের জানাই স্যালুট।

[ সমাপ্ত ]

===============================
#হেরে যাওয়া মানুষ
#আবুল বাশার পিয়াস

“যে শহরে ১০০টাকায় নারীদেহ পাওয়া যায় সেই শহরে নারীর জন্য কান্না করতে যাবো কেন?”
ছেলেটার কথা শুনে একটু অবাক হলাম। ল্যাম্পপোস্টের হলুদ সোডিয়ামের আলোতে খেয়াল করলাম ছেলেটা চোখের জল আটকানোর বারবার বৃথা চেষ্টা করছে। অর্ধখাওয়া সিগারেটটা ছেলেটার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম,
- টানার অভ্যাস আছে?
ছেলেটা আমার হাত থেকে সিগারেটটা নিয়ে নিকোটিনের ধোঁয়া আকাশে ছাড়তে ছাড়তে বললো,

- “মালিহার সাথে আমার ৩ বছরের প্রেম। অথচ ১৫ দিনের পরিচয়ে সে অন্য একটা ছেলের সাথে রাত কাটালো। আচ্ছা সে যখন অন্য একটা ছেলের সামনে ন*গ্ন হচ্ছিলো তখন কি একবারও আমার কথা মনে হয় নি? মনে হয় নি সেই সব দিনের কথা? যাকে এক পলক দেখার জন্য সারাদিন ওর বাসার সামনের কদম গাছে বানরের মতো ঝুলে থাকতাম। এলাকার মানুষজন তো আমার নামও দিয়েছিলো “কদম গাছের বান্দর”। ছেলেটা যখন ওর উন্মুক্ত বুকে নাক ঘষছিলো তখন তার একবারও মনে হয় নি আমার কথা? তার থেকে দূরে থাকতে হবে বলে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েও ভর্তি হই নি। ছেলেটা যখন লালসার চিহ্ন ওর সারা গায়ে একে দিচ্ছিলো তখন কি তার একবারও মনে হয় নি আমার কথা? আমার চুম্বন তো শুধু ওর কপালেই আটকে ছিলো। কখনো তো কপাল থেকে ঠোঁট অব্দি পৌছায় নি। তাহলে কি এটাই আমার ভুল ছিলো?”

ছেলেটার প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারি নি। শুধু যাওয়ার সময় সিগারেটের প্যাকেটটা ছেলেটার হাতে দিয়ে বললাম,

-যদি পারো কষ্টগুলো নিকোটিনের ধোঁয়ার সাথে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করো। যদি কষ্ট উড়াতে পারো তাহলে হয়তো বেঁচে যেতে পারো…
রাত কয়টা বাজে জানি না। বাসা থেকে বের হবার সময় ঘড়ি, ফোন কোনটাই সাথে আনি নি। দিন হলে হয়তো সূর্য দেখে বলে দেওয়া যেতো কয়টা বাজতে পারে । চাঁদ দেখে বলা সম্ভব না। পিছনে যে ছেলেটাকে ফেলে এসেছি সে হয়তো আজ সারারাত সিগারেটের সাথে নিজেও পুড়বে। বারবার চোখের জল মুছবে আর নিজেই নিজেকে বুঝাবে, “যে শহরে ১০০টাকা দিয়ে নারীদেহ পাওয়া যায় সেই শহরে নারীর জন্য কাদবো কেন?”
একসময় হয়তো নিজের কাছে নিজেই হেরে যাবে…
অনেকক্ষণ ধরে খেয়াল করছি একটা কুকুর আমার পিছন পিছন হাটছে। আমি কুকুরটাকে জিজ্ঞেস করলাম,

- কিরে, তুই কি কোন কুত্তীর মায়ায় আটকেছিলি?
কুকুরটা আমার দিকে তাকিয়ে কয়েকবার ঘেউঘেউ করলো। আর অর্থ হলো,
“ কারো মায়াতে আটকানোর সময় নাই। ভাদ্র মাসে সবাই সমান”
কুকুরটা ঠিকিই বলেছে। এই শহরে এখন ভাদ্রমাস চলছে। কেউ বা ৩ বছরের প্রেম ভুলে অন্যের সামনে কাপড় খুলছে আর কেউ বা—---
ঘেউ ঘেউ ( যার অর্থ, তুই কি কারো মায়াতে আটকেছিস?”)
এই প্রশ্নের কোন উত্তর দেই নি। হাঁটতে হাঁটতে ব্রীজের উপর এসে যখন দাঁড়ালাম তখন খেয়াল করি এক তরুণী ব্রীজের রেলিংয়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে। আমি পিছন থেকে মেয়েটাকে বললাম,

-ঝাঁপ দিয়ে লাভ নেই। মরবেন না। নদীতে এখন হাটু পানি। উল্টো কাঁদায় মাখামাখি হবেন
মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে মনমরা ভাবে হেসে বললো,
- “ যার সর্বাঙ্গে কাঁদা লেগে আছে তার শরীরে নতুন করে আর কি কাঁদা লাগবে?”
আমি বললাম,

-যেহেতু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মরে যাবেন সেহেতু একটু সময় নিয়ে মরুন। দেখা গেলো মরার জন্য ঝাঁপ দিলেন অথচ মরলেন না। উল্টো নদীর দূষিত পানি খেয়ে পেট খারাপ হয়ে গেলো।

মেয়েটা কিছুক্ষণ চুপ থেকে মাথা নিচু করে বললো,
- “এই সময়টা যে আমার হাতে নেই। ভালোবাসা টিকিয়ে রাখতে নিজের শরীরটা বিলিয়ে দিলাম। যখন বুঝতে পারলাম আমার শরীরের মাঝে অন্য একটা শরীরের অস্তিত্ব প্রকাশ পাচ্ছে তখন ভালোবাসার মানুষের হাতে পায়ে ধরে বললাম, চলো বিয়েটা করে ফেলি। সে বিয়ে করে নি নিজের ক্যারিয়ারের জন্য। বরং আমাকে বাধ্য করেছে এমন একজনকে খু*ন করতে যার এখনো জন্মই হয় নি। ভালোবাসা টিকিয়ে রাখতে এটাও করলাম। কিন্তু যার জন্য এতো পাপ করলাম তাকে পেলাম না। সরকারী বড় পোস্টে জব পেয়ে যাবার পর মানুষটা আমায় বলে দিলো তার সাথে নাকি আমাকে মানায় না। আজ অন্য একটা মানুষকে বিয়ে করে নিলো। অন্য একটা নারীর চোখের দিকে যখন সে তাকাবে তখন কি আমার কথা ওর একবারও মনে পড়বে না? ও কি ভুলে যাবে ওর যখন শূন্য পকেট ছিলো তখন আমি কোনদিন ৩ বেলা খাবার খাই নি। একবেলা খেয়ে বাকি দুইবেলার খাবারের টাকা ওর হাতে তুলে দিয়েছি। ঐ নারীর হাতটা যখন স্পর্শ করবে তখন কি ওর একবারও মনে পড়বে না আমার কথা? যে আমি ২০ টাকা বাস ভাড়া বাচানোর জন্য রোদে পুড়ে পায়ে হেঁটে চলাচল করেছি।

অন্য মেয়ের শাড়ির আঁচলটা যখন ও সরাবে তখন ও কি ভুলে যাবে আমি রঙ জ্বলে যাওয়া সালোয়ার কামিজ পড়তাম শুধু ওর পরিহিত জামাটা যেন চকচক করে?”
আমি মেয়েটার প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারি নি। শুধু যাবার আগে এটাই বললাম,
- সাঁতার না জানলে হাটু পানিতেও মৃত্যু হতে পারে। যদি সাঁতার জানেন তাহলে বেঁচে যেতে পারেন…
কুকুরটা এখনো আমার পিছন পিছন হাটছে। আমি কুকুরটা বললাম,
-তুই জানিস ছেলেটা সিগারেটের প্যাকেটটা শেষ করে নিজের দেহ থেকে নিজেকে বিসর্জন দিবে?
কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করলো যার অর্থ হলো ( চলে যাওয়ার জন্যই আমরা জন্মেছি। আমাদের চলে যেতেই হবে)
- তুই এটা জানিস, মেয়েটা সাঁতার জানার পরেও মেয়েটা মারা যাবে?
কুকুরটা আবারও ঘেউঘেউ করলো, যার অর্থ হলো ( বেঁচে থাকার ইচ্ছে শক্তি ফুরিয়ে গেছে বলেই মেয়েটার মৃত্যু হবে)

-তুই এটা জানিস, কিছুক্ষণ পর চলন্ত একটা গাড়ি আমার এই দেহটাকে থেতলে দিয়ে চলে যাবে? কুকুরটা এইবার নিশ্চুপ হয়ে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। এইবার মনে হলো কুকুরটা সত্যি সত্যি আমায় কিছু বলতে চাইছে কিন্তু কথা বলার ক্ষমতা নাই দেখে সে বলতে পারছে না। যদি তার কথা বলার ক্ষমতা থাকতো তাহলে সে বলতো, “কেন নিজেকে নিজে শেষ করে দিতে চাইছিস।”
আমার উত্তর হতো তখন,

- এক জোড়া সোনার বালার কাছে ১ ডজন কাঁচের চুড়ির মূল্য নিতান্তই কম। আচ্ছা আমার স্ত্রী যখন অন্য একটা পর পুরুষের খোলা পিঠে নখের আঁচড় কাটছিলো তখন কি তার একবারও আমার কথা মনে হয় নি? সে কি ভুলে গিয়েছিলো সেইসব দিনের কথা? প্রতিদিন বাসায় ফেরার সময় তার জন্য বুক পকেটে করে বেলীফুলের মালা আনা। শাড়ির কুচি গুলো ঠিক করে তার বাঁকা টিপটা সোজা করে দেওয়ার কথা কিংবা মাঝরাতে দুইজনের ঝুম বৃষ্টিতে ভিজা?

আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। ঝপসা চোখে তাকিয়ে দেখি র*ক্তে ভিজে আছে কাচের চুড়ি গুলো। কুকুরটা সমানে ঘেউঘেউ করছে। হয়তো সে বলতে চেষ্টা করছে, “ কেন এমনটা করলি? মানুষতো এর চেয়েও বেশি কষ্ট নিয়ে বাঁচে।”

আমার নিথর দেহটা রাস্তায় পড়ে রইলো। কুকুরটা আমার পাশে বসে ঘেউ ঘেউ করতে লাগলো যার অর্থ হলো, ( আমি অভিশাপ দিলাম এই শহরের সেই সব প্রেমিক-প্রেমিকার মৃত্যু হোক, যারা শুধু একজনকেই নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসে ঠকেছিলো)।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url